চাইল্ড সেক্সুয়ালিটি ও আমাদের যা জানা প্রয়োজন

শুরুতেই একটি দৃশ্যপট কল্পনা করিঃ 

আপনি রান্নাঘরে রান্না করছেন, পাশের ঘরে আপনার ৪/৫/৬ বছর বয়সী শিশুটি আপনার প্রতিবেশীর শিশুর সাথে খেলছে যার বয়স প্রায় আপনার সন্তানেরই মতো। অনেকক্ষণ সাড়া শব্দ নেই ভেবে আপনি রান্নাঘর থেকে গিয়ে হঠাৎ রুমের দরজায় দাঁড়াতেই দেখতে পেলেন--
   
আপনার শিশু এবং প্রতিবেশীর শিশুটি প্যান্ট খুলে একে অন্যের প্রাইভেট পার্টে হাত দিচ্ছে এবং এটুকু দেখেই আপনার হাত-পা থেমে আসছিলো, এখন প্রশ্ন হলো এই পরিস্থিতিতে আপনি কী করবেন?   

ভয় পাবেন? অবাক হবেন? চিৎকার করে উঠবেন? ধমক দিবেন? মারবেন? আপনার সন্তানকে খারাপ ভাবতে শুরু করবেন? সন্তান যেন আর কোন দিন এরকম কাজ না করে এটি বলবেন? ছিঃ এটা খুব খারাপ বা পঁচা কাজ, এটি বলবেন? টেনশনে নির্ঘুম রাত কাটাবেন? প্রতিবেশী বাচ্চাটিকে বা তার মা-বাবাকে খারাপ ভাববেন?  

এতক্ষণ যে একটি দৃশ্যপট আমরা কল্পনা করলাম সেটি হলো চাইল্ড সেক্সুয়ালিটি, এটা শিশুর অন্যান্য ডেভেলপমেন্টাল ধাপের মতোই একটা ধাপ। আমাদের মা-বাবাদের এই বিষয়ে আগে থেকে জেনে রাখা এবং কিভাবে এই বিষয়টিকে সামলাবো তার সঠিক প্রস্তুতি থাকা অত্যন্ত জরুরি৷ আমরা মা-বাবারা আমাদের সন্তানের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং আন্তরিক শিক্ষক। তাই এসব বিষয়ে আমরা যদি সঠিক সময়ে সঠিক আচরণ না করি তবে ভুল শিক্ষকেরা ভুল শিক্ষা দিয়ে আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের জীবনের অনেক বড় ক্ষতি করতে পারে।     

একটা সময় মনে করা হতো শিশুরা হচ্ছে asexual অর্থাৎ তাদের কোন সেক্সুয়ালিটি নেই। কিন্তু বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট Sigmond Freud সর্বপ্রথম উনার গবেষনায় এটি প্রকাশ করেন যে শিশুদেরও সেক্সুয়ালিটি আছে এবং এটি শিশুর জন্মের পর ১ম বছর থেকেই ডেভেলপ করে থাকে। মা-বাবা'রা যখন শিশুকে আদর করে, চুমু খায়, জড়িয়ে ধরে তখন শিশুরাও এক ধরনের sensation অনুভব করে, তবে তা এডাল্টদের মতো নয়। ওদের সেনসেশনটা খুবই নিষ্পাপ থাকে।   

এই চাইল্ড সেক্সুয়ালিটি টাকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়, ২-৪ বছর বয়সী শিশুরা প্রথম ভাগে পড়ে, আর ৪-৬ বছর বয়সী শিশুরা পড়ে দ্বিতীয় ভাগে

** ২-৪ বছর বয়সী শিশুরা আসলে নিজের শরীর নিয়ে বেশ কৌতুহলী হয়। এই বয়সী শিশুদের এক ধরনের কৌতূহল তৈরি হয় তার প্রাইভেট পার্ট সম্পর্কে জানার, এরই অংশ হিসেবে প্রাইভেট পার্ট স্পর্শ করার চেষ্টা করে। এছাড়াও বড়দের প্রাইভেট পার্ট সম্পর্কেও এক ধরনের কৌতূহল তৈরি হয়। এমনকি নিজেকে জামা-কাপড় ছাড়া দেখারও এক ধরনের কৌতূহল তৈরি হয়। ২ বছর বয়স থেকে একটি শিশু নারী-পুরুষের মধ্যকার পার্থক্যও বুঝতে শুরু করে।  

**৪-৬ বছর বয়সে শিশুরা এই বিষয়ে আরও বেশি কৌতূহলী হয় এবং এই বিষয়ে এক্সপ্লোর করতে তাড়না বোধ করে। বড়দের প্রাইভেট এক্টিভিটিস তাদের বড় রকমের কৌতূহলের বিষয় হয়ে ওঠে। এই বয়সী শিশুদের সেক্সুয়াল ডেভেলপমেন্ট এর মধ্যে আরও যা যা হয়, সেটা হলো - 

১) শিশু (ছেলে বা মেয়ে) প্যান্টের মধ্যে বার বার হাত দেয়া থেকে শুরু করে একটানা হাত ঢুকিয়ে রাখতে পারে, হাত দিয়ে ঘষতে পারে যেটাকে বলা হয় মাস্টারবেশন। এতে শিশুর একধরনের শারীরিক ভালো লাগা কাজ করে।   

২) খেলার সঙ্গীদের সাথে একে অন্যের প্রাইভেট পার্ট দেখাদেখি ও স্পর্শ করেতে পারে। 

৩) এ বিষয়ে শিশুরা বাচ্চা কীভাবে হয় এ বিষয়ে খুবই কৌতূহল বোধ করে। 

৪) শিশুরা বর-বউ খেলা করে এবং বর-বউয়ের মতো এক্টিভিটিস করার চেষ্টা করতে পারে। 

৫) তারা হঠাৎ করেই গোসল ও নিজের পোশাক বদলের ব্যাপারে বাড়তি প্রাইভেসি কনসার্ন হয়ে ওঠে। 

৬) নারী ও পুরুষের পার্থক্য সম্পর্কে তারা এক ধরনের কৌতূহলী হয়ে ওঠে। 

এই সবকিছুই হচ্ছে শিশুর ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে খুবই ন্যাচারাল একটা পার্ট। একটা শিশু যেমন ধীরেধীরে বসতে, হামাগুড়ি দিতে, হাঁটতে শিখে, ঠিক একইভাবেই এগুলো তারা বিকাশের অংশ হিসেবেই করে থাকে। আর এই বিষয়টি মাথায় রেখেই মা-বাবাদের হ্যান্ডেল করতে হয়। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন গাইডলাইন নেই, তবে কিছু জেনারেল গাইডলাইন এমন হতে পারে --- 

১। ২ বছর বয়স এর মধ্যে শিশুকে তার বডি পার্টস চেনানো (প্রাইভেট পার্টস সহ)। 

২। প্রাইভেট পার্টসের কোন রূপক নাম নয়, বরং সঠিক নামই বলা ভালো৷ এতে করে শিশুর যদি কোন শারীরিক সমস্যা বা অসুখ হয় সে আপনাকে, ডাক্তারকে সঠিক তথ্য দিতে পারবে, স্কুলেও কোন সমস্যার মুখোমুখি হলে বা এবিউজিং এর মতো কোন বিষয় ঘটলে সঠিক তথ্যটি দিতে পারবে৷   

৩। একটি ৪-৬ বছর বয়সী শিশুর কাছে আইসক্রিম খাওয়া যতটা মজাদার, তার প্রাইভেট পার্ট নিয়ে খেলা করাটাও ঠিক ততোটাই মজাদার। এটাকে আইসক্রিম এর সাথে এজন্য তুলনা করা হচ্ছে কারণ এটাকে সত্যিকারের সেক্স হিসেবে সে বুঝে না। এটা তার কাছে হঠাৎ করে আবিষ্কার করা একটি আনন্দের উৎস। যেহেতু সে আনন্দ পায়, তাই সে তার এই হঠাৎ আবিষ্কৃত আনন্দের স্বাদ বারবার নিতে চায়। 

৪। একটি শিশুর কৌতূহল কখনো বড়দের বেঁধে দেওয়া গ্রিন লাইট বা রেড লাইট বুঝে না। তাই শিশু যখন এই বিষয়গুলোতে খুব কৌতূহল দেখায় তখন আমাদেরও এ বিষয়গুলোতে খুব স্বাভাবিকতা দেখানো উচিৎ।

৫। শিশু যেন মা-বাবাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারে তা শুনতে যেমনই হোক সেই সুযোগ বা পরিবেশ রাখা জরুরি। মনে রাখতে হবে, এই সময়ে এই বিষয়ে আমরা যেমনভাবে এই বিষয়টি ডিল করবো টিনেজে তার ছাপ থাকবে। আমরা যদি এই সময়ে সঠিকভাবে শিশুকে বুঝতে এবং বুঝাতে পারি তাহলে আশ করতে পারি টিনেজে-- যখন নাকি মানুষ সত্যিকারের এডাল্ট সেক্স নিয়ে আগ্রহী হয় তখন সে ততো পজিটিভ এবং মার্জিত চিন্তা করতে সক্ষম হবে। 

৬। শিশুর এই বিষয়ক প্রশ্নের অনেস্ট উওর দেয়াটাও জরুরি তবে তা একটু কৌশলে বয়স উপযোগী করে দেয়াটা খুব ভালো। যেমনঃ আপনার ৫ বছরের শিশুটি জিজ্ঞেস করলো-- মা বাচ্চা কোথা থেকে আসে? আমরা সাধারণত বলি-- ফুল বাগানে থাকে, হাসপাতালে থাকে ওখান থেকে আমরা আনি৷ এসব না বলে এটা বলা যেতে পারে--বাচ্চা মায়ের মধ্যে থাকে এবং সময় হলে আসে। অর্থাৎ কাল্পনিক কোন উত্তর না দিয়ে শিশুর উপযোগী করে বাস্তবিক উত্তর দেয়া ভালো।     

৭। আপনার শিশু যদি তার প্রাইভেট পার্টে হাত দেয়, ঘষে, বা কোন খেলার সংগীর সাথে প্রাইভেট পার্ট এক্সপ্লোর করার চেষ্টা করে তবে মা-বাবা হিসেবে আমাদের রিয়েকশন হতে পারে---

--যদি শিশু ড্রয়িং রুমে, অন্যদের সামনে, বাজারে, পার্কে তার প্যান্টের ভেতর হাত দেয় বা প্রাইভেট পার্ট ধরে তবে আপনি আস্তে করে ওকে বলতে পারেন এটা প্রাইভেট কাজ, এটা যেখানে সেখানে করেনা, করতে হয়না। তবে বলার সময় খুব স্বাভাবিক গলার টোন, এক্সপ্রেশন থাকা সবচেয়ে ভালো। এটা বাচ্চাকে প্রাইভেসি বা বডি প্রাইভেসি শেখানোরও দারুন কৌশল।

---যদি অন্য শিশুর সাথে ডাক্তার খেলা/বর বউ খেলা/প্রাইভেট পার্টস এক্সপ্লোর করার সময় দেখেন তবে আপনি ধমক বা রাগ, মারধর না করে আস্তে করে বলতে পারেন --তোমরা আমার সাথে আসো আমার তোমাদের হেল্প দরকার/ অন্য বাচ্চাটিকে আস্তে করে যথাসম্ভব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলতে পারেন যে তোমার আম্মু তোমাকে ডাকে। অর্থাৎ ওদেরকে ডাইভার্ট করে দেয়া/ আলাদা করে দেয়া ভালো।। অন্য সময়ে সুযোগ বুঝে আপনার শিশুকে বুঝাবেন যে এগুলো ছোট শিশুরা করেনা। 

---এইসব বিষয়ে আপনার সন্তানকে কখনো খারাপ/চরিত্রহীন/অসভ্য এসব বলবেন না। ও যা করছে বা করে এগুলো পৃথিবীর প্রতিটি শিশুই করে, করেছে, করবে। এগুলো খুবই ন্যাচারাল বিষয়। বরং আমরা যদি এগুলোতে নেতিবাচক এবং কড়া মনোভাব দেখাই তাতে করে শিশুর এই বিষয়ে একটা জোরালো আগ্রহ এবং নেতিবাচক সক্রিয়তা তৈরি হবার সম্ভাবনা থাকবে। 

---আমরা যদি এই বিষয়টাকে খুব খারাপ এমন মনোভাব নিয়ে সন্তানের সাথে ডিল করি বা এই এই করলে ও খারাপ বা পঁচা হয়ে যাবে এমন বুঝাই তবে কিন্তু সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে যে বাচ্চারা কোন সেক্সুয়াল এবিউজমেন্টের শিকার হলে আমাদের কাছে শেয়ার করবে না। আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিশুই এই বিষয়গুলো মা-বাবাকে বলতে চায়না ভয়ে এবং অস্বস্তিতে যেহেতু তাদেরকে সেই স্পেস দেয়া হয়না। তারা ভাবে এটা মা-বাবাকে বললে মা-বাবা ওকে খারাপ ভাববে। তাই আমাদের এমন একটা পজিশনে থাকতে হবে যেন আমাদের সন্তানেরা মন খুলে তাদের মনে আসা এই বিষয়ক প্রশ্নগুলো আমাদের করতে পারে এবং তাতে করে আমাদের হাতেও সুযোগ থাকবে  ওদেরকে সুন্দর এবং বয়স উপযোগী করে দরকারী লেসন দেয়ার।  

সন্তানকে ভুল বুঝার আগে, খারাপ ভাবার আগে আমাদের জানা দরকার আসল বিষয়টি কী এবং মা-বাবা হিসেবে আমরা সেই বিষয়ে কী ভূমিকা পালন করতে পারি। 

বিষয়টি অত্যন্ত সেনসিটিভ। এই বিষয়ে জানুন, বুঝুন, প্রস্তুতি নিন, শিশুকে সুন্দর শিক্ষা দিন।    

আমাদের দেশে 'সেক্স' শব্দটিই কেমন যেন নিষিদ্ধ একটি শব্দ এবং নোংরা একটি বিষয় হয়ে আছে। অথচ আমরা প্রতিটি মানুষ পৃথিবীতে এসেছি এই অতি প্রাকৃতিক বিষয়ের মাধ্যমেই। তাই এই বিষয়ে কিছু লিখতে গেলে বেশ স্ট্রেস লাগে। কিন্তু তারপরও যেহেতু বিষয়টি আমাদের সন্তানদেরকে নিয়ে তাই আমাদের এই বিষয়ে জানা খুবই দরকার। আমরা সঠিকভাবে জানলেই আমাদের সন্তানদের সঠিকভাবে পরিচালনা করার সুযোগ তৈরি হবে। 

#লেখাঃ শারমিন শামুন
প্যারেন্টিং এর পাঠশালা  থেকে সংগৃহীত।

#তথ্যসূত্রঃ

1. Freud, Sigmund. Three essays on the theory of sexuality: The 1905 edition. Verso Books, 2017. 

2. Eisenberg, Arlene, Heidi Murkoff, and Sandee Hathaway. What to expect the toddler years. Workman Publishing, 2009.

3. Rosemond, John. John Rosemond's New Parent Power!. Vol. 11. Andrews McMeel Publishing, 2001

4. Sears, William, and Martha Sears. The discipline book: How to have a better behaved child from birth to age ten. New York: Little, Brown, & Co, 1995.

Comments