চলুন সালাতুল খুসুফ বা চন্দ্রগ্রহণের নামাজ পড়ি

আজ (২৬ মে) সন্ধ্যায় চন্দ্রগ্রহণ হবে ইনশাআল্লাহ
চলুন সালাতুল খুসুফ বা চন্দ্রগ্রহণের নামাজ পড়ি

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অসংখ্য কুদরতের মধ্যে অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ। আজ বুধবার (২৬ মে, ২০২১) সন্ধ্যায় পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ হতে যাচ্ছে ইনশাআল্লাহ। সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত থাকতেন। এ সময়ে সালাত আদায় করা ও তাওবা-ইস্তিগফার করে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা সুন্নাহ।

আজকের চন্দ্রগ্রহণের সাথে দেখা যাবে সুপারমুন। চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসে, ফলে চাঁদ স্বাভাবিকের চাইতে বড় ও উজ্জল দেখা যায়। এ কারণে একে সুপারমুন বলা হয়। এবারের সুপারমুন স্বাভাবিকের চেয়ে ১৫% উজ্জল ও ৪% বড় হবে বলে জোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন। মে মাসে অনেক ফুল ফোটে। উত্তর গোলার্ধে এখন বসন্তকাল চলছে। তাই এবারের সুপার মুনকে বলা হবে 'সুপার ফ্লাওয়ার ব্লাড মুন'।

=================
This Copied from Muslims Day Android App
=================

অবস্থান ভেদে দেশের আকাশে মেঘের উপস্থিতির সাপেক্ষে সন্ধ্যা ৬ঃ৩০ থেকে প্রায় রাত ৮টা পর্যন্ত চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে।
ঢাকায় চন্দ্রগ্রহণ শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টা ৪১ মিনিটে এবং শেষ হবে ৭টা ৫১ মিনিট ১৮ সেকেন্ডে। ময়মনসিংহে শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টা ৪২ মিনিট ৪২ সেকেন্ডে এবং শেষ হবে ৭টা ৫৩ মিনিটে। চট্টগ্রামে সন্ধ্যা ৬টা ৩২ মিনিট ১৮ সেকেন্ডে ‍শুরু হবে এবং শেষ হবে ৭টা ৪২ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে। সিলেটে শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টা ৩৭ মিনিট ১৮ সেকেন্ডে এবং শেষ হবে ৭টা ৪৭ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে।

খুলনায় শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টা ৪২ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে এবং শেষ হবে ৭টা ৫২ মিনিট ৪২ সেকেন্ডে। বরিশালে শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টা ৩৯ মিনিটে এবং শেষ হবে ৭টা ৫৩ মিনিট ১৮ সেকেন্ডে। রাজশাহীতে শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টা ৪৮ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডে এবং শেষ হবে ৭টা ৫৯ মিনিট ১২ সেকেন্ডে। আর রংপুরে শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টা ৪৯ মিনিট ৩০ সেকেন্ডে এবং শেষ হবে ৭টা ৫৯ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডে।

॥॥ সালাতুল কুসূফ (সূর্যগ্রহণের সালাত) ও সালাতুল খুসুফ (চন্দ্রগ্রহণের সালাত) ॥॥
--------------------------------------------------------------
সূর্য ও চন্দ্র যখন গ্রহনের সময় আমাদের নবী (সা.) এর চেহারা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যেতো। তখন তিনি সাহাবীদের নিয়ে জামাতে নামাজ পড়তেন, কান্নাকাটি করতেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। আরবীতে সূর্যগ্রহণকে 'কুসূফ' আর চন্দ্রগ্রহণকে 'খুসুফ' বলা হয়। আর সূর্যগ্রহণের নামাজকে 'সালাতুল কুসূফ' এবং চন্দ্রগ্রহণের নামাজকে 'সালাতুল খুসুফ' বলা হয়।

দশম হিজরীতে যখন পবিত্র মদীনায় সূর্যগ্রহণ হয়, ঘোষণা দিয়ে লোকদেরকে নামাজের জন্য সমবেত করা হয়েছিল। তারপর সম্ভবত নবীজির (সা) জীবনের সর্বাধিক দীর্ঘ নামাজের জামাতের ইমামতি করেছিলেন। সেই নামাজের কিয়াম, রুকু, সিজদাহ মোটকথা, প্রত্যেকটি রুকন সাধারণ অভ্যাসের চেয়ে অনেক দীর্ঘ ছিলো।

হাদীসের দলিলের আলোকে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ও ইমাম সুফিয়ান সাওরির (রঃ) মতে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের নামাজটি ২টি রুকু ও ৪টি সিজদা সহকারে দুই রাকাত বিশিষ্ট। অর্থাৎ আমরা যে কোনো সুন্নত-নফল ২ রাকাত নামাজ যেভাবে পড়ি এ নামাজও সেই একই নিয়মে পড়তে হবে। যদিও অন্য হাদীসে চার রুকু ও চার সিজদার মাধ্যমে দুই রাকাত নামাজ পড়ার বর্ণনাও পাওয়া যায়। এ বর্ণনার আলোকে অন্য মাজহাবের অনেক ইমামগণ দ্বিতীয় পদ্ধতির ব্যাপারে মত দিয়ে থাকেন।

সূর্যগ্রহণকালীন সালাতুল কুসূফ নামাজ মসজিদে জামাতের সাথে পড়া সুন্নাহ। তবে একাকী ঘরে পড়লেও তা আদায় হবে। ইমাম আবু হানিফার (রহ) মতে চন্দ্রগ্রহণের নামাজ বাসায় পড়া উত্তম যেহেতু এটা রাতে পড়তে হয়। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই এ নামাজ পড়া সুন্নাহ।

॥॥ সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ কেন হয়? ॥॥
-------------------------------
সূর্য, চাঁদ, পৃথিবী এক সরল রেখাতে এলে গ্রহণের ঘটনা ঘটে। সূর্যগ্রহণের সময়, ভ্রমণরত অবস্থায় চাঁদ কিছু সময়ের জন্য পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন কিছু সময়ের জন্য পৃথিবীর কিছু জায়গা থেকে সূর্যকে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে আর দেখা যায় না। চাঁদের ছায়া এসে পৌঁছায় পৃথিবীর ওপর। যে কারণে ছায়া পড়া অংশে খানিক সময়ের জন্য দিনের আলো থাকে না।

অপরদিকে চন্দ্রগ্রহণ হয়, যখন চাঁদ আর সূর্যের মাঝখানে থাকে পৃথিবীর অবস্থান। পৃথিবী তখন আলোর উৎস বন্ধ করে দেয়। ফলে সূর্য থেকে কিছু সময়ের জন্য চাঁদের উপর আলো পড়ত পারে না। তখন আমরা চাঁদের পৃষ্ঠে পৃথিবীর ছায়া দেখতে পাই।

অবিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা প্রথম যখন মহানবী (সা.) এর সালাতুল কুসূফের (সূর্যগ্রহণের নামাজের) আমল সম্পর্কে জানতে পারলো, তখন তারা এটা নিয়ে বিদ্রুপ করলো (নাউযুবিল্লাহ)। তারা বললো, এ সময় এত ভয় পাওয়ার বা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার কী যৌক্তিকতা আছে? সূর্যগ্রহণের সময় চন্দ্রটি পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে চলে আসে বলে সূর্যগ্রহণ হয়। ব্যস এতটুকুই! এখানে কান্নাকাটি করার কী আছে? মজার বিষয় হলো, বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় যখন এ বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু হলো, তখন মহানবী (সা.) এই আমলের তাৎপর্য বেরিয়ে আসলো।

আধুনিক সৌর বিজ্ঞানীদের মতে, মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহ দু'টি কক্ষপথের মধ্যবলয়ে রয়েছে এস্টিরয়েড (Asteroid), মিটিওরিট (Meteorite) ও উল্কাপিন্ড প্রভৃতি ভাসমান পাথরের এক সুবিশাল বেল্ট, এগুলোকে এক কথায় গ্রহানুপুঞ্জ বলা হয়। গ্রহানুপুঞ্জের এই বেল্ট (Belt) আবিষ্কৃত হয় ১৮০১ সালে। এক একটা ঝুলন্ত পাথরের ব্যাস ১২০ মাইল থেকে ৪৫০ মাইল। বিজ্ঞানীরা আজ পাথরের এই ঝুলন্ত বেল্ট নিয়ে শঙ্কিত। কখন জানি এ বেল্ট থেকে কোন পাথর নিক্ষিপ্ত হয়ে পৃথিবীর বুকে আঘাত হানে, যা পৃথিবীর জন্য ধ্বংসের কারণ হয় কিনা? গ্রহানুপুঞ্জের পাথর খন্ডগুলোর মাঝে সংঘর্ষের ফলে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথর খন্ড প্রতিনিয়তই পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে। কিন্তু সেগুলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এসে জ্বলে ভস্ম হয়ে যায়। কিন্তু বৃহদাকার পাথর খন্ডগুলো যদি পৃথিবীতে আঘাত করে তাহলে কী হবে? প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে এমনই একটি পাথর আঘাত হেনেছিলো। এতে ডাইনোসরসহ পৃথিবীর তাবৎ উদ্ভিদ লতা গুল্ম সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। Arizon এ যে উল্কাপিন্ড এসে পড়েছিলো তার কারণে পৃথিবীতে যে গর্ত হয়েছিলো তার গভীরতা ৬০০ ফুট এবং প্রস্থ ৩৮০০ ফুট।

বিজ্ঞানীরা বলেন, সূর্য অথবা চন্দ্রগ্রহণের সময় ঝুলন্ত পাথরগুলো পৃথিবীতে ছুটে এসে আঘাত হানার আশংকা বেশী থাকে। কারণ হচ্ছে, এসময় সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবী একই সমান্তরালে, একই অক্ষ বরাবর থাকে। ফলে তিনটির মধ্যাকর্ষণ শক্তি একত্রিত হয়ে ত্রিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এমনি মুহূর্তে যদি কোন পাথর বেল্ট থেকে নিক্ষিপ্ত হয় তখন এই ত্রিশক্তির আকর্ষণের ফলে সেই পাথর প্রচন্ড শক্তিতে, প্রবল বেগে পৃথিবীর দিকে আসবে, এ প্রচন্ড শক্তি নিয়ে আসা পাথরটিকে প্রতিহত করা তখন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ফলে পৃথিবীর একমাত্র পরিণতি হবে ধ্বংস। একজন বিবেকবান মানুষ যদি মহাশূন্যের এ তত্ত্ব জানে, তাহলে তার শঙ্কিত হবারই কথা।

এই দৃষ্টিকোন থেকে সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণের সময় মহানবী (সা.) এর সেজদারত হওয়া এবং সৃষ্টিকূলের জন্য পানাহ চাওয়ার মধ্যে আমরা একটি নিখুঁত বাস্তবতার সম্পর্ক খুঁজে পাই। মহানবী (সা.) এর এ আমলটি ছিলো যুক্তিসঙ্গত ও একান্ত বিজ্ঞানসম্মত। তাই এটিকে উৎসব না বানিয়ে আল্লাহকে ভয় করা ও দুনিয়া-আখিরাতের নিরাপত্তা চেয়ে সালাত আদায় করা উচিত।

॥॥ সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে কুসংস্কার ॥॥
----------------------------------------------------
চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ নিয়ে আমাদের দেশে অসংখ্য কুসংস্কার আছে। অনেক কুপ্রথা আছে। যেগুলো আসলে কোনো ভাবেই ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। আগের কালের 'মুরুব্বি'দের ধারণাপ্রসূত এসব কুসংস্কারগুলো বিজ্ঞান বা ইসলাম সম্মত নয়। যেমন- বলা হয়ে থাকে সূর্যগ্রহণের সময় গর্ভবতী নারী মুরগি কাটলে বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নেয়। এসময় রান্না করা বা খাওয়া যাবে না ইত্যাদি। এসকল কথাই ভিত্তিহীন ও কুসংস্কার। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কোনো বিষয়কে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ মনে করাকে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছেন। যা অনেক সময় শিরকের পর্যায়ে চলে যায়।

চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় করণীয় কী সে বিষয়ে সুস্পষ্ট হাদীস রয়েছে। রাসূল (সাঃ) বলেন "... চন্দ্র ও সূর্য আল্লাহর দু'টি নিদর্শন। আর চন্দ্র গ্রহণ ও সূর্য গ্রহণ কারো জন্ম ও মুত্যুর কারণে সংঘটিত হয় না। অতএব তোমরা যখন চন্দ্র গ্রহণ ও সূর্য গ্রহণ দেখতে পাও, তখন তাকবীর পড় আর আল্লাহর কাছে দু'আ কর এবং সলাত আদায় কর ও সদাক্বাহ্‌ কর।...।" (মুসলিম ১৯৭৪ http://ihadis.com/books/muslim/hadis/1974)

রাসূল (সাঃ) এর পুত্র ইবরাহীম যেদিন ইন্তিকাল করেন সেদিন সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। সাহাবিরা বলাবলি করছিলেন যে রাসূলের (সা) পুত্র ইন্তিকাল করায় সূর্যগ্রহণ হয়েছে। সে প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে যে 'কারো জন্ম বা মৃত্যুতে তার আলো নিষ্প্রভ হয় না'।

এমনিভাবে প্রত্যেক ভীতিকর অবস্থাতে যেমন- প্রবল বাতাস প্রবাহকালে, অতিবৃষ্টি, গাঢ় অন্ধকার, ভূমিকম্প ইত্যাদি সময়ে নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব। চন্দ্র গ্রহণের নামাজ কারও কারও মতে, সূর্য গ্রহণের নামাজের অনুরূপ মসজিদে জামাতের সঙ্গে আদায় করা সুন্নত। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন, যেহেতু এ নামাজ রাত্রিকালীন তাই ঘরে একাকী আদায় করা উত্তম।

আল্লাহ আমাদেরকে চন্দ্র-সূর্যের গ্রহণকালীন ক্ষতিকর বিকিরণ ও অন্যান্য যে কোনো আশংকা বা বিপর্যয় যদি থেকে থাকে তা থেকে রক্ষা করুন। আমাদেরকে রক্ষা করুন সকল ধরণের কুসংস্কার ও কুপ্রথা পালন করা থেকে। আমাদেরকে অটল রাখুন রাসূলের (সা) সুন্নাহ এর উপর। আমীন।

দাওয়াহ এর নিয়তে পোস্টটি শেয়ার করতে পারেন।

Comments